জাবাল-ই-নূর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি

বাংলাদেশে শিশু দারিদ্র্য: পরিস্থিতি বিশ্লেষণ

সারসংক্ষেপ

বাংলাদেশে শিশু দারিদ্র্য একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে, যদিও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। লাখ লাখ শিশু এখনও বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মুখোমুখি হচ্ছে—শুধু আয় নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি ও সুরক্ষা থেকেও তারা বঞ্চিত। দারিদ্র্যের প্রভাব শিশুদের ওপর গভীর ও দীর্ঘমেয়াদী, যা তাদের বিকাশ, সুযোগ ও জীবনমানকে প্রভাবিত করে।

বর্তমান পরিসংখ্যান

  • জাতিসংঘ শিশু তহবিল (UNICEF) ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS)-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৪.৫ কোটি শিশু বাস করে, যার মধ্যে প্রায় ৫০% জাতীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে।
  • প্রায় ৪০% শিশু বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে ভুগছে, অর্থাৎ তারা একাধিক ক্ষেত্রে (যেমন: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, স্যানিটেশন) বঞ্চনার শিকার।
  • শিশু অপুষ্টির হার এখনও উচ্চ: ২৮% শিশু খর্বাকৃতির এবং ৯.৮% শিশু অতিরিক্ত দুর্বল (BDHS 2022)।
  • ৪০ লাখেরও বেশি শিশু শিশুশ্রমে যুক্ত, যার মধ্যে অনেকেই বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করছে (ILO, 2023)।

শিশু দারিদ্র্যের প্রধান দিকগুলো

১. আয়-ভিত্তিক দারিদ্র্য

  • দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারগুলোর শিশুরা পুষ্টিকর খাবার, নিরাপদ আশ্রয়, মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।
  • কোভিড-১৯ মহামারি ও মূল্যস্ফীতির মতো অর্থনৈতিক ধাক্কা অনেক পরিবারকে আরও গভীর দারিদ্রে ঠেলে দিয়েছে।

২. শিক্ষাগত বঞ্চনা

  • যদিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হার বেশি, তবুও ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য, বিশেষত দরিদ্র পরিবার ও কন্যাশিশুদের মধ্যে।
  • শিক্ষার মান খুবই নিম্ন, যার পেছনে রয়েছে দুর্বল অবকাঠামো, অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব এবং শিশুশ্রম।

৩. স্বাস্থ্য ও পুষ্টি

  • গ্রামাঞ্চল ও বস্তি এলাকায় মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ সীমিত।
  • দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার এখনও বেশি।

৪. শিশু সুরক্ষা

  • দারিদ্র্যপীড়িত শিশুরা সহিংসতা, নির্যাতন, পাচার, বাল্যবিবাহ ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের ঝুঁকিতে থাকে।
  • আইনি ও শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রায়ই দুর্বল ও দরিদ্র জনগণের নাগালের বাইরে থাকে।

৫. বাসস্থান ও স্যানিটেশন

  • অনেক শিশু ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি বা গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে যেখানে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা নেই, যা তাদের রোগের ঝুঁকিতে ফেলে।

ভৌগোলিক ও সামাজিক বৈষম্য

  • শিশু দারিদ্র্যের হার গ্রামীণ এলাকা, জাতিগত সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী শিশু ও নগর বস্তির বাসিন্দাদের মধ্যে বেশি।
  • রংপুর, ময়মনসিংহ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু অংশে দারিদ্র্য ও বঞ্চনার হার সবচেয়ে বেশি।

মূল কারণসমূহ

  • কাঠামোগত দারিদ্র্য ও বৈষম্য
  • অপর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা
  • দুর্বল শাসনব্যবস্থা ও জনসেবা প্রদান
  • জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ (যেমন: বন্যা, ঘূর্ণিঝড়)
  • অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা ছাড়া দ্রুত নগরায়ন

সরকার ও এনজিওর প্রতিক্রিয়া

  • বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি চালু করেছে (যেমন: উপবৃত্তি, স্কুল ফিডিং, টিকাদান কর্মসূচি)।
  • তবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এখনও দরিদ্রতম শিশুদের জন্য যথেষ্ট নয়।
  • UNICEF, সেভ দ্য চিলড্রেন, BRAC-এর মতো এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ

  • শিশুবিষয়ক দারিদ্র্য নির্দেশক নিয়ে খণ্ডিত ও সীমিত তথ্য
  • শিশু-কেন্দ্রিক সেবা খাতে বাজেট বরাদ্দ কম
  • শিশু অধিকার সম্পর্কিত নীতিমালার বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণে দুর্বলতা

হস্তক্ষেপের সুযোগ

  • শিশু সংবেদনশীল সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার
  • প্রারম্ভিক শৈশব উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় বিনিয়োগ
  • কমিউনিটি-ভিত্তিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচি সম্প্রসারণ
  • জলবায়ু সহনশীলতা ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারগুলোর ক্ষমতায়ন
  • সরকার, এনজিও ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি